আলাউল হোসেন
বাংলাদেশের সমুদ্রগামী বাণিজ্যিক নৌ-সেক্টর ক্রমাগত প্রসার লাভ করছে, যার পেছনে অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে আধুনিক মেরিটাইম প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানসমূহ। এই ধারাবাহিকতায় দেশের পাঁচটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন সরকারি মেরিন একাডেমির মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম হলো বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি, পাবনা। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ এই রেজিমেন্টাল মেরিটাইম প্রতিষ্ঠানটি পাবনা জেলার বেড়া উপজেলার নান্দনিক নগরবাড়ী ঘাট সংলগ্ন নাটিয়াবাড়ী মৌজায় অবস্থিত। যমুনা নদীর তীরবর্তী প্রাকৃতিক পরিবেশে নির্মিত এই একাডেমিটি বাংলাদেশের নৌশিক্ষার এক অনন্য সংযোজন।
একাডেমির যাত্রা ও অর্জন
২০২১ সালের ৬ মে বাংলাদেশের মেরিটাইম শিক্ষার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটে বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি, পাবনার উদ্বোধনের মাধ্যমে। যাত্রা শুরুর পর থেকেই প্রতিষ্ঠানটি ধারাবাহিক সাফল্যের মাধ্যমে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করেছে। ইতোমধ্যে দুইটি ব্যাচ সফলভাবে দুই বছরের প্রি-সী প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করে গ্র্যাজুয়েশন করেছে এবং দেশি-বিদেশি জাহাজে কর্মরত থেকে নিজেদের মেরিটাইম দক্ষতা প্রমাণ করছে। এ পর্যন্ত মোট ১০৯ জন ক্যাডেট সফলভাবে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেছেন, যা একটি নবীন প্রতিষ্ঠানের জন্য গৌরবজনক সাফল্য।
আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা
বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি, পাবনা আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ সুবিধা নিশ্চিত করতে অত্যাধুনিক অবকাঠামো ও প্রযুক্তিনির্ভর সরঞ্জামে সজ্জিত। এখানে রয়েছে:
- শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ডিজিটাল শ্রেণীকক্ষ
- আধুনিক ল্যাবরেটরি ও মেরিন ওয়ার্কশপ
- নব্য প্রযুক্তির মেরিন ডিজেল ইঞ্জিন ও সিমুলেটর রুম
- কম্পিউটার ল্যাব ও নেভিগেশন যন্ত্রপাতি
- আধুনিক গ্রন্থাগার
- আন্তর্জাতিক মানের সুইমিং পুল
- জিমনেসিয়াম, খেলার মাঠ ও প্যারেড গ্রাউন্ড
এই সমস্ত সুযোগ-সুবিধার মাধ্যমে ক্যাডেটরা বাস্তবিক ও আধুনিক জাহাজ পরিচালনা সংক্রান্ত জ্ঞানে সমৃদ্ধ হয়ে উঠে।
প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ও সহায়ক কর্মসূচি
STCW-২০১০ অনুযায়ী মূল প্রশিক্ষণের পাশাপাশি এখানে DG Shipping অনুমোদিত Ancillary কোর্স চালু রয়েছে। কেবল পেশাগত প্রশিক্ষণেই নয়, ক্যাডেটদের মানসিক বিকাশে সহায়ক নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে:
- সাপ্তাহিক বিতর্ক প্রতিযোগিতা
- বার্ষিক ইন্টার-ডিভিশন খেলাধুলা
- সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও সাঁতার প্রতিযোগিতা
- সাময়িকী প্রকাশনা
- শিক্ষা সফর ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল ভিজিট
এই সকল কর্মসূচি শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিত্ব বিকাশ, নেতৃত্বগুণ এবং দেশপ্রেম জাগ্রত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
প্রশিক্ষকের মান ও পরিচালনা
একাডেমির পেশাগত প্রশিক্ষণ পরিচালনা করেন সমুদ্রগামী অভিজ্ঞ ক্যাপ্টেন ও চীফ ইঞ্জিনিয়ারগণ, যারা নিজেদের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও আন্তর্জাতিক জ্ঞান দ্বারা ক্যাডেটদের প্রস্তুত করে তোলেন। একাডেমিক বিষয়সমূহে পাঠদান করেন সংশ্লিষ্ট বিষয়ের দক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষকবৃন্দ। এছাড়া শারীরিক প্রশিক্ষণ, প্যারেড, শৃঙ্খলা ও শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির কাজ পরিচালনা করেন বাংলাদেশ নেভি থেকে নিয়োজিত অফিসার ও পেটি অফিসাররা।
রিসোর্স শেয়ারিং ও সংযুক্তি
প্রশিক্ষণের গুণগত মান আরও উন্নত করতে একাডেমিটির রয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে রিসোর্স শেয়ারিং চুক্তি। উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানসমূহ হল:
- বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি, চট্টগ্রাম
- পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
- এডওয়ার্ড কলেজ, পাবনা
- ন্যাশনাল মেরিটাইম ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম
এছাড়াও, প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির অধিভুক্ত, যা একাডেমিক ও পেশাগত দুই ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বাড়তি সুবিধা।
কমিউনিটি উন্নয়নে অবদান
শুধু নিজস্ব পরিসরেই নয়, বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি, পাবনা আশেপাশের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে সরাসরি ভূমিকা রাখছে। একাডেমির পক্ষ থেকে এলাকার দরিদ্র জনগণের মাঝে সুপেয় পানির ব্যবস্থা, শীতবস্ত্র বিতরণ, সেলাই প্রশিক্ষণ ও মেশিন বিতরণ, আর্থিক সহযোগিতা ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এভাবে প্রতিষ্ঠানটি স্থানীয় পর্যায়ে সামাজিক দায়িত্ব পালনের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
নেতৃত্ব ও দৃষ্টিভঙ্গি
প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান কমান্ড্যান্ট ক্যাপ্টেন মোঃ তৌফিকুল ইসলাম একাডেমির শুরু থেকেই নিজ নেতৃত্বদক্ষতা ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটিকে একটি আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণকেন্দ্রে রূপান্তরের নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সীমিত জনবল ও নানা প্রতিকূলতা থাকা সত্ত্বেও একাডেমির শৃঙ্খলা, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং প্রশিক্ষণের মান উন্নয়নে তাঁর ভূমিকা প্রশংসনীয়।
তিনি বলেন, “এলাকার জনগণের সর্বাত্মক সহযোগিতা না পেলে এই বৃহৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব হতো না। আমরা কৃতজ্ঞ এই জনপদের মানুষের প্রতি, যারা একাডেমির পথচলায় পাশে থেকেছেন।”

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি, পাবনা শুধু দক্ষ নাবিক তৈরি করছে না, এটি আগামী দিনে বেকারত্ব হ্রাস, জাতীয় আয় বৃদ্ধিতে এবং স্থানীয় যুবসমাজের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করবে। এখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে নবীন ক্যাডেটগণ আত্মবিশ্বাসের সাথে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবে।
“শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তীতা ও অর্জিত জ্ঞানকে কাজে রূপান্তর”—এই মূলমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে ক্যাডেটগণ ব্যক্তি, সমাজ ও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অনন্য ভূমিকা রাখবে এবং বৈষম্যহীন সমাজ নির্মাণে এগিয়ে আসবে।
বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি, পাবনা আজ শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়; এটি দক্ষ, দেশপ্রেমিক ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন মেরিটাইম অফিসার তৈরির এক আলোকবর্তিকা। জাতির উন্নয়নে দক্ষ জনবল গঠনে এই প্রতিষ্ঠানটির অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্ব ও সামাজিক দায়বদ্ধতায় বিশ্বাসী এই একাডেমি বাংলাদেশের সমুদ্র অর্থনীতির ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার একটি ভিত্তিপ্রস্তর।
Lorem Ipsum has been the industry’s standard dummy text ever since the 1500s, when an unknown printer took a galley of type and scrambled it to make a type specimen.
Lorem Ipsum has been the industry’s standard dummy text ever since the 1500s, when an unknown printer took a galley of type and scrambled it to make a type specimen.
Lorem Ipsum has been the industry’s standard dummy text ever since the 1500s, when an unknown printer took a galley of type and scrambled it to make a type specimen.