আলাউল হোসেন
বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গনে যদি এক নীরব অথচ দীপ্ত নক্ষত্রের কথা বলা হয়, তবে নিঃসন্দেহে উঠে আসে প্রিয়াংকা গোপের নাম। যিনি নিজের শ্রম, নিষ্ঠা ও অবিচল সাধনার মাধ্যমে সংগীতের রাজপথে স্থাপন করেছেন এক অনন্য স্বাতন্ত্র্য। প্রিয়াংকা গোপ কেবল একজন গায়িকা নন, তিনি এক জীবন্ত অধ্যায়—যিনি উচ্চাঙ্গ সংগীত, রবীন্দ্রসংগীত ও নজরুলগীতিকে আপন কণ্ঠে নতুন ব্যঞ্জনায় পৌঁছে দিয়েছেন শ্রোতার হৃদয়ে।
শৈশবের ছন্দে শুরু
টাঙ্গাইল শহরের বিন্দুবাসিনী গার্লস স্কুলে পড়াশোনা করা এক বিজ্ঞানমনস্ক মেয়ে—তাঁর ভেতরেই বাস করছিল এক শিল্পীমন। পিতা বাসুদেব চন্দ্র গোপ ও মাতা ভানুরানী গোপ মেয়ের প্রতিভাকে বিকশিত করতে তাঁকে ভর্তি করান নাচ শেখার স্কুলে। তবে সুরের টানে নৃত্যকে বিদায় জানিয়ে প্রিয়াংকা বেছে নেন সংগীতকেই। এ ছিল এক অন্তর্জাগতিক আহ্বান, যার টানে তিনি সুরের জলধিতে অবগাহন করতে শুরু করলেন।
শিক্ষার আলোয় আলোকিত সংগীতপথ
প্রিয়াংকার সংগীতচর্চার পরিসর ক্রমেই বিস্তৃত হতে থাকে। ভারতে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাওয়ার সুযোগ তাঁর শিল্পীজীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এই প্রতিষ্ঠানেই তিনি অনার্সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম এবং মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় হয়ে প্রমাণ করেন তাঁর অঙ্গীকার ও মেধার ঔজ্জ্বল্য। তাঁর গুরু ছিলেন পণ্ডিত অরুণ ভাদুড়ী—যিনি উচ্চাঙ্গ সংগীতের বরেণ্য সাধক। এ ছাড়াও আনন্দ চক্রবর্তী, অসিত রায়, ওয়াহিদুল হক, সুবীর নন্দী ও শুভ্রা গুহর মতো কিংবদন্তিদের কাছ থেকেও তিনি সংগীতের পাঠ নেন।
কণ্ঠে উচ্চারণ করেন আত্মার আরাধনা
প্রিয়াংকার কণ্ঠ এমন এক সুরের আধার, যেখানে মিশে থাকে ধ্রুপদী শাস্ত্রীয় সংগীতের গাম্ভীর্য, রবীন্দ্রনাথের কাব্যিকতা এবং নজরুলের জ্বালা ও বেদনা। তাঁর গাওয়া একটি গান যেন শ্রোতার মনে সৃষ্টি করে এক অন্তর্জাগতিক রসাস্বাদন। তিনি একাধারে বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত শিল্পী—তাঁর রবীন্দ্রসংগীত যেমন ছুঁয়ে যায় আত্মাকে, তেমনি উচ্চাঙ্গ সংগীতে তিনি প্রকাশ করেন এক অসীম শুদ্ধতা।
চলচ্চিত্রে আগমন: 'অনিল বাগচীর একদিন'
প্লেব্যাক গায়িকা হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণের মধ্য দিয়ে ২০১৪ সালে। এরপরে ২০১৫ সালে হুমায়ূন আহমেদের কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্র অনীল বাগচীর একদিন-এ। এই চলচ্চিত্রে গান গেয়েই তিনি ২০১৫ তে পেয়ে যান জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার—শ্রেষ্ঠ নারী কণ্ঠশিল্পীর স্বীকৃতি। এটি ছিল তাঁর চলচ্চিত্রজগতে প্রথম কাজ, অথচ প্রথম কাজেই সেরার মুকুট জয়। একই বছর ঘাসফুল সিনেমায় “বহুদিন পর” গান শ্রোতাপ্রিয় হয়।
সংগীতজগতে অজস্র পুরস্কার ও স্বীকৃতি
প্রিয়াংকা গোপ তাঁর সংগীত প্রতিভা দিয়ে অর্জন করেছেন বহু সম্মাননা। তাঁর ঝুলিতে রয়েছে—
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ আরটিভি অ্যাওয়ার্ড, ৪ বার চ্যানেল আই অ্যাওয়ার্ড, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য উদয় ভূষণ স্মৃতি পুরস্কার, পশ্চিমবঙ্গ সংগীত একাডেমিতে নজরুল সংগীতে প্রথম, ঠুমরিতে প্রথম, খেয়ালে দ্বিতীয় (২০০৪), ডোবারল্যান্ড মিউজিক কনফারেন্সে ২০০৮ সালে ঠুমরি ও খেয়ালে চ্যাম্পিয়ন, বাংলাদেশ জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদে প্রথম (২০০০), জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহে নজরুলসংগীতে স্বর্ণপদক (২০০১) ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা থেকে অসংখ্য পুরস্কারপ্রাপ্তি।
শিক্ষায়, সাধনায়, নেতৃত্বে
বর্তমানে প্রিয়াংকা গোপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। একাডেমিক নেতৃত্বের পাশাপাশি তিনি সংগীতচর্চা ও শিক্ষাদান দুই ক্ষেত্রেই নিজের অবদান রেখে চলেছেন। তাঁর প্রকাশিত অ্যালবামগুলো প্রমাণ করে—তিনি সময় ও সংস্কৃতিকে ধারণ করে, ক্ল্যাসিক্যাল সংগীতকে জীবন্ত করে রাখছেন এক অদ্ভুত মাধুর্যে।
একজন সুরসাধিকারিণীর প্রতিচ্ছবি
প্রিয়াংকা গোপ কেবল গান গেয়ে শ্রোতার হৃদয় জয় করেন না, তিনি তাঁদের নিয়ে যান এক গভীর ধ্যানমগ্নতার ভেতর। তাঁর গানে আছে এক ধীর, পরিশীলিত আবেশ—যেখানে সুর ও বাণী পরিণত হয় এক আত্মিক উপাসনায়। তিনি যেন এক মণিহার—যার প্রতিটি সুরমণি জ্বলজ্বল করে শিল্পীসত্তার দীপ্তিতে।
প্রিয়াংকা গোপ আমাদের মনে করিয়ে দেন—প্রকৃত শিল্পচর্চা হলো একাগ্র সাধনা, নিরব ধারাবাহিকতা আর অন্তরের সত্য অন্বেষণ। তিনি ক্ল্যাসিক্যাল ও আধুনিকতার সেতুবন্ধন—যিনি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দিচ্ছেন সংগীতের মহিমান্বিত উত্তরাধিকার। তাঁকে শুধু একজন গায়িকা বললে ভুল হবে, তিনি সংগীতের এক সমগ্রতাময় সাধক। তাঁর গান শোনা মানেই হৃদয়ের গভীরতম স্থানে এক স্নিগ্ধ ছোঁয়া অনুভব করা।
সুরের এই সাধিকা যেন বহুকাল আমাদের সংস্কৃতির বাতিঘর হয়ে জ্বলে থাকেন—এই আমাদের প্রার্থনা।
Lorem Ipsum has been the industry’s standard dummy text ever since the 1500s, when an unknown printer took a galley of type and scrambled it to make a type specimen.
Lorem Ipsum has been the industry’s standard dummy text ever since the 1500s, when an unknown printer took a galley of type and scrambled it to make a type specimen.
Lorem Ipsum has been the industry’s standard dummy text ever since the 1500s, when an unknown printer took a galley of type and scrambled it to make a type specimen.